১৯৭১ সালে রণাঙ্গনের বীর সম্মুখযোদ্ধা, শহীদ–সুলেমান হোসেন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়।
বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহনে অগ্রণী ভুমিকায় অবর্তীর্ণ শহীদ সোলেমান হোসেন। পড়ালেখায় ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। বরমচালে জন্মগ্রহণ না করেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে স্বর্ণাক্ষরে লিখে গিয়েছেন বরমচালের স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠ বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম।রণাঙ্গনে স্মমুখভাগে অগ্রসর হয়ে চালিয়ে গিয়েছেন শত্রুপক্ষের উপর গুলি।
জন্ম
১৯৫০ সালে পহেলা ফেব্রুয়ারী শহীদ সুলেমান হোসেন বিশ্বনাথ উপজেলার কামাল বাজার এলাকার ছোটদিঘী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল ওহাব ও মাতা খায়রুন্নেছা। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।তাঁর পিতা ছিলেন সিলেট শহরের রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক।
তার বাবা আব্দুল শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন আদর্শবান, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও নীতিবান ছিলেন। অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন ছিলেন।তার আপোষহীন নীতির কাছে এলাকার দুশকৃতিকারিরা পরাজিত হয়ে রাতের অন্ধকারে ঘরে ডুকে ঘুমের মধ্যে তাকে হত্যা করে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত অবস্থায় পর তাঁর পিতার আকস্মিক মৃত্যু পরিবারে যেমন শোকের ছায়া নেমে আসে তেমনি তাঁর শিক্ষা জীবনে তেমনি অন্ধকারের ঘনঘটা দেখা দেয়। এ অবস্থায় তাঁর মা তাঁর আট ভাই,বোন সহ সবাই কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল নন্দনগর গ্রামে তাঁর নানার বাড়ী কলিম উল্ল্যাহ জিল্লাদারের বাড়ি (বর্তমানে বরমচাল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইসহাক চৌধুরী ইমরান ও আইনজীবী মুফিজুন্নুর চৌধুরীর বাড়ি)চলে যান।
এবং পিতার হারানোর শোক নিয়ে বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে কঠোর অধ্যাবসায় নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে ১৯৬৫ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করার পর সেখান থেকে সিলেট এম সি কলেজে ভর্তি হয়ে সফলতার সহিত কৃতকার্য হয়ে ১৯৬৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করে পরবর্তীতে মদন মোহন কলেজে বি এ–তে ভর্তি হন।
১৯৭০ সালে বি.এ. টেষ্ট পরীক্ষায় সোলেমান হোসেন কলেজ মেধা ভিত্তিক স্থান লাভ করে প্রথম হন তার সাথে কলেজে সক্রিয় রাজনীতি ও তাঁর পিতার আদর্শ তাকে সংগ্রামী জীবন গঠনে উৎসাহিত করে। তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠ ও সংগঠনের সুযোগ্য নেতৃত্ব সচেতন জনগণের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এর পর ১৯৭০ সালে বি.এ টেষ্ট পরীক্ষায় সম্মিলিত বিভাগে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন।
শহীদ সুলেমান সংগ্রামী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পূর্বে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিশেষ করে তাঁর প্রদানকৃত একটি বক্তব্য ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ঘোষিত ছয় দফায় অনুকূলে যাওয়ার কারণে বিমান বাহিনীতে তাঁকে রিক্রুট করা হয়নি। সংগ্রামী ছিলেন বলেই হয়তো সৈনিক জীবনে কমিশন র্যাঙ্ক এ ভর্তি হতেও চেয়েছিলেন। একবার ভাইভা পরিক্ষায় তার প্রশ্নোত্তর বাংলা কৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-তোমার প্রিয় কবি কে?রবীন্দ্রনাথ না ইকবাল। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থাকতে এ বাংলার মানুষ অন্য কাউকে চিন্তা করতে পারে না।
সুলেমান হুসেন জানতেন আত্ম-প্রতারণা করে প্রশ্নোত্তরে ইকবাল বললেই চাকুরী হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি দেশপ্রেমে ছিলেন আপোষহীন। উত্তরে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন রবীন্দ্রনাথ।এমন উত্তরে ফলাফল আবারো তার প্রতিকুলে গেল।এর পর তিনি দক্ষিণ সুরমা মকন উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
এরই মধ্যে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে অতপ্রতভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন।পাকিস্তানে তখন ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী জোয়ার বইছে তখন তিনি কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর পক্ষে কাজ করেন। সে নির্বাচনে ওসমানী জয়লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর গ্রামেগঞ্জে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তিত্বের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বি.এ. পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ না করেই এক বিশাল ছাত্র বাহিনী নিয়ে সুলেমান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান। ২৬ মার্চ যুদ্ধ আনুষ্ঠানিক মোড় নিলে মদন মোহন কলেজের পাশে তাঁর খালার বাসায় নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে দেয়ালে বড় আকারে ‘জয় বাংলা’ লিখে তাঁর নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করেন। তাঁর নিজের রক্তে দেয়ালে লিপিবদ্ধ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি অনেক দিন পর্যন্ত অক্ষত ছিল। তিনি কতটুকু ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক এ ঘটনাটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।এমনটিই জানালেন তার খালাতো বোন বরমচাল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা জুন্নারা বেগম।
দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, আমাদের বিজয়ের সূর্য যখন পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে, ঠিক তখনি আনন্দের তীব্রতা এবং সাহসে বলীয়ান হয়ে তীব্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখভাগে যোদ্ধে। সেই যুদ্ধে অনেক শক্রসেনাকে খতম করতে সফল হলেও এক পর্যায় শক্রসেনারা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। জানা যায়,পাকবাহিনী বেয়নেট চার্জে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদ সোলেমানের স্মৃতি মনে এলেই আমি যে কথাটি ভাবি, তা হচ্ছে মাত্র কটি দিনের জন্য আমাদের মহান বিজয় দেখে যেতে পারেননি তিনি। কখনো ভাবি, তিনি বোধহয় এভাবেই তার প্রাণটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। আর চেয়েছিলেন বলেই মৃত্যু ভয়কে পরোয়া না করে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
স্বাধীনতা যোদ্ধে অকুতোভয় বীর সেনা শহীদ সুলেমান হোসেন আমাদের বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের গর্ব এবং আমাদের অহংকার। মুক্তিযোদ্ধে জীবন আত্ন ত্যাগের জন্য তাকে রাষ্ট্র কর্তৃক মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।
শহীদ সুলেমানের সৃতিকে ধারন করে তার গ্রামের নাম ‘ছোট দীঘলকে’ পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘সুলেমান নগর’। আর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ‘জিন্নাহ হলের’ নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে ‘শহীদ সুলেমান হল’।কিন্তু আমাদের বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ে তার সৃতিবহন করে এমন একটি আলোকচিত্র বরমচাল গনকেন্দ্র পাঠাগারে স্থান পেলেও আর কিছুই স্থান পায় নি বিদ্যালয়ে। যা অনেকটা দুঃখের বিষয়।
এই মহান বীর আমাদের মনে চির অম্লান হয়ে থাকবেন তার কর্মের কারণে। শহীদ সুলেমানের মত আরো হাজারো তরুণের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই লাল সবুজের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার এই মাসে যারা দেশের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ও শহিদ সুলেমান হোসেনের পরিবারের কাছে জোরাল দাবি আপনারা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মুক্তি যোদ্ধে অংশগ্রহণকারী এ বীর সেনা শহিদ সুলেমান হোসেনের জীবনি সংবলিত লিপিবদ্ধ বই ও তার সৃতিবহন করে এমন কিছু স্থায়ী জিনিস বা স্থাপনা স্থান দিয়ে বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা আগামি প্রজন্মকে তার সম্পর্কে জানার একটা ব্যাবস্থা গ্রহণ করলে তারা উপকৃত হব বলে মনে করি।
তথ্যসূত্রঃ জুন্নারা বেগম,শহিদ সুলেমান হুসেনের খালাতো বোন ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা বরমচাল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

!doctype>